Friday, May 24, 2024

রিকশা চালকের ডাক্তার কন্যা

 প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি সময় আমি রিকশা চালাই। এই ত্রিশ বছরে আমি দেখসি অধিকাংশ প্যাসেঞ্জারেরই মাথা গরম। তারা হুদাই বকাঝকা করে।

এক সকালের কথা। এক বাপ তার মেয়েরে কলেজে নেওয়ার জন্য আমারে ডাক দেয়। বাপটা আমারে বারবার বলতাছিল, সাবধানে চালাবেন কিন্তু! তিনি মেয়েরেও বলতেছিলেন- রিকশায় শক্ত করে ধরে রাখবা। মেয়েটারে নিয়া আমি যখন রিকশা ছাড়মু তিনি আমারে আবারও বললেন- "দেখে শুনে আস্তে সাবধানে চালাবেন, আমার মেয়েটা যেন ব্যাথা না পায়।"
বেশ খানিকটা দূর, আমি রিকশা চালাইতেছি, শুনলাম পিছনে ফুপাইয়া ফুপাইয়া কান্নার শব্দ, মেয়েটা কানতেছে। ভাবলাম জিগাই- সব ঠিক আছে তো। কিন্তু মেয়েটা আমারে পিছন ফিরতে দেখে উল্টা ধমক দিয়া বলল, "আপনে রিকশা চালান, পিছন ফিরবেন না!"
কিছুক্ষণ পর মেয়েটা রিকশা থামাইতে বলল তার মোবাইল বের করে কারে যেন কল দিতে লাগল। সে জোরে জোরে কথা বলতাছিল আর তখনও কানতাছিল। আমি যা বুঝার বুঝে গেলাম। মেয়েটা কোন ছেলের সাথে বাড়ি থেকে পালাইতাছে। কিন্তু সেই ছেলের দেখা নাই।
আচমকা আমি কিছু বোঝার আগেই মেয়েটা রিকশা থেকে লাফ দিয়া নেমে গেল। যাওয়ার আগে সিটের উপর টাকা ছুড়ে দিল। আমি দেখলাম মেয়েটা রেললাইনের দিকে যাইতাছে। আমি আর কী করব, রিকশা ঘুরাইয়া চলে যাইতে চাইলাম। মেয়েটার বাপের জন্য আমার কেন জানি খুব কষ্ট হইতাছিল। আমার খালি মনে হইতাছিল, কোনো বাপ এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবেনা।
আমি ফিরে যেতে চাইয়াও যাইতে পারলাম না। আমার কানে শুধু বাজতাছিল মেয়ের বাপের কথাগুলা, সাবধানে চালাবেন...। আমি আমার রিকশা থামাইলাম। পিছন ফিরলাম আর দৌড়ে মেয়েটার কাছে গেলাম।
সে তখন রেললাইনে, উল্টাপাল্টা ভাবে হাটতেছে যেন নিজেকে শেষ করে দিবে আজই। আমি তার কাছে ছুটে গেলাম আর কইলাম- আমার সাথে চলেন। মেয়েটা অদ্ভুত চোখে আমারে দেখল। সে পাগলের মতো কানতাছিল। আর আমারে বলছিল, "চলে যান, মূর্খ অশিক্ষিত।"
কিন্তু অপরিচিত জনহীন জায়গায় আমি মেয়েটারে একা ফালাইয়া যাইতে পারি নাই। মেয়েটা কানতেছিল, আমি অপেক্ষা করতাছিলাম। এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা, আকাশ কালো হইয়া গেল, মেঘ জমছে, বৃষ্টি হইব। বৃষ্টি নামার ঠিক আগ মুহূর্তে মেয়েটা উঠে দাঁড়াইলো আর আমারে কইলো, "আপনার রিকশা নিয়ে আসেন।"
বাকি রাস্তা আমরা আর কোন কথা কই নাই। সে বলল - "চাচা, আপনি আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবেন না, এবং কাউকে কোনদিন বলবেন না আপনি আমাকে চিনতেন।"
আমি মাথা নামিয়ে চলে আসছিলাম। আমি সেদিন কাউরে কিছু বলি নাই।
ঐদিন ঘরে গিয়া আমি কিছুই খাইতে পারি নাই। কেবল মনে হইতাছিল -
এইটাই বোধহয় ভালো, আমার কোন কন্যা সন্তান নাই।
.
.
আট বছর পর, এইতো কিছুদিন আগে আমার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়, আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলছিলাম। রাস্তার মানুষজন ধরাধরি কইরা আমারে হাসপাতালে নিয়া যায়। যখন আমার জ্ঞান ফিরা আসে আমি দেখি একটা মেয়ে আমার যত্ন নিতাছে।
সে আমারে জিজ্ঞাস করল, আমার এখন কেমন লাগতাছে। তারপর কইলো আমি তারে এতো বছরে একবারের জন্যও আর কেন দেখতে যাই নাই!
সাদা পোশাক পরা সেই মেয়েটারে আমি চিনতে পারি নাই।
খুব ভালা চিকিৎসা হইছিল আমার। খুব বড় ডাক্তার আমারে দেখতে আসছিল। যখন বড় ডাক্তার আমারে দেখতে আসল মেয়েটা উনারে বলছিল,
"স্যার, ইনি আমার বাবা।"
সেই বড় ডাক্তার মেয়েটারে ইংরেজিতে কিছু বলতাছিল। মেয়েটা তখন আমার ব্যাথার জায়গায় হাত বুলাইয়া দিয়া বলছিল- "সেদিন যদি আমার এই বাবা না থাকত, আমি আজ ডাক্তার হতে পারতাম না"
হাসপাতালের ছোট বিছানায় আমি চোখ বন্ধ করে শুইয়া ছিলাম। আমি কাউরে কোনদিন বুঝাইতে পারবনা, সেদিন আমার মনের মধ্যে কেমন লাগতাছিল।
আমার মতো রিকশা চালকের একটা কন্যা আছে, একটা ডাক্তার কন্যা।
-বাবলু শেখ
writing: GMB Akash

Source :: https://www.facebook.com/100063642721214/posts/962321779232571/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...