Monday, June 24, 2024

সিক্ত

আপা বলেছিলো, 'তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। তুই কি আসতে পারবি ভাইয়া? একটাবার?'
বাসটা ঢাকা থেকে আরিচা ফেরিঘাটে পৌঁছানোর সাথে সাথেই ফোনটা এসেছিলো‌। চাচার ফোন। চাচা কাঁপা কাঁপা গলায় খবরটা দিলেও তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার কল কেটে তাড়াতাড়ি আব্বাকে কল দিলাম। আব্বা কান্নার দমকে কিছু বলতে পারছিলেন না। আমার আর কিছু শোনারও প্রয়োজন ছিলো না। আমার বাস তখন ফেরির ওপর। ফেরি তার বুকে অসংখ্য বাস-গাড়ি নিয়ে মেঘনা পাড়ি দিচ্ছে। মেঘনার অতল জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভীষণ কান্না পেলো। ভেবেছিলাম প্রাণভরে কাঁদবো। কিন্তু আমার চোখটা যেন শুকনো খটখটে মরুভূমির মতো হয়ে গিয়েছিলো। এক ফোঁটা কান্নাও বেরুলো না আমার চোখ দিয়ে।
আপার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো গত ঈদের সময়। অন্যান্যবার বাড়ি গেলে যেমন জ্বালায় আমাকে, সেবার সেরকম করেনি।‌ বরং মুখে এক অসীম গাম্ভীর্য ধরে রেখেছিলো, যেন কতোদিনের কষ্টের এক বোঝা বয়ে চলেছে সে। আমার তখন জিজ্ঞেস করা দরকার ছিলো, 'কি ব্যাপার?' ওর হাতটা ধরে আমার বলা উচিৎ ছিলো, 'আপা, তোর সমস্যাটা বল।' আমি তা করিনি। আমি চিরদিনের অমানুষের মতো তাকে উপেক্ষা করে গিয়েছিলাম। যদি তা না করতাম, হয়তো আজকের দিনটা আর আসতো না।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। উঠোনে পা দিতেই দেখলাম, অনেক মানুষ। সারা গ্রামের মানুষ আমাদের বাসায় ভেঙে পড়েছে। তারা ঘিরে আছে উঠোনের একটা অংশ। আমি তাদের ভীড় ঠেলে সেই অংশের দিকে এগিয়ে যাই। সেখানে একটা খাটিয়া রাখা।‌ খাটিয়ার পাশে আমার বাবা, মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।‌ পিছনের ঘরে মায়ের আহাজারি শুনছি। আর খাটিয়ায় শুয়ে আছে শর্মী। আমার বড় বোন। দুদিন আগেও যে বলেছিলো, আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
শর্মী আপু আর আমি ছিলাম পিঠাপিঠি। দুজনের দুজনার সাথে একদমই বনতো না। আমি ওকে দুচোখে দেখতে পারতাম না, সেও আমাকে দেখতে পারতো না। দুজন একঘরে থাকলে মারামারি বাধতোই। শেষে আব্বা আম্মার ছুটে এসে মারামারি থামানো লাগতো। মারামারি তখন থামতো ঠিক, কিন্তু এর জের থামতো না। দেখা যেত, সেই একই বিষয় নিয়েই আমরা আবার পরদিন মারামারি শুরু করে দিয়েছি।
আমাদের নিয়ে তারা খুব পেরেশানিতে থাকতেন আব্বা আম্মা। দুটো মাত্র বাচ্চা, তারা যদি সারাদিন মারপিট করে বেড়ায়, তবে কোন বাবা-মায়েরই বা ভালো লাগবে? শেষপর্যন্ত তারা আমাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন আমাদের মধ্যে আর কখনো মিলমিশ হবে না।
অথচ ঢাকায় যাওয়ার সময় আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছিলো আপুর জন্য। আপু আমাকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। আমিও কাঁদছিলাম। যে আমি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েও এক ফোঁটা কাঁদি নাই, সেই আমিই জোরে জোরে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। আমি বুঝতেও পারিনি, আপার জন্য এতো মমতা লুকিয়ে ছিলো আমার মনের ভিতর।
সেই মমতাটা আজকেও টের পাচ্ছি।‌হালকা হালকা বৃষ্টিতে আপুর সাদা কাফন একটু একটু ভিজছে। আশেপাশের সবাই তাগাদা দিচ্ছে জানাজার নামাজটা তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু সেসব কথার কিছুই আমার কানে ঢুকছিলো না। আমি আপাকে দেখছিলাম। তার শান্ত হয়ে যাওয়া অবাক স্নিগ্ধ মুখটাকে দেখছিলাম।
আপার বিয়ে হয়েছিলো গত বছরের ডিসেম্বরে। ছুটি ছিলোনা, তাই বিয়েতে আসতে পারিনি। আপার অনেক গালি শুনেছিলাম‌। আপার সাথে যার বিয়ে হয়েছিলো, মোস্তাফিজ ভাই, তিনি খাটিয়ার পাশে বসে আব্বার মতোই কাঁদছেন। ছেলে মানুষদের কান্না দেখতে অদ্ভুত লাগে‌। বাবাকে দেখেছি কোনো ব্যাপারেই ভেঙে পড়েননি কখনো। মোস্তাফিজ ভাইও সেরকম। অথচ আজ দুজনেই ভেঙে পড়েছেন ঝড়ে পড়া গাছের মতো।
জানাজা শেষ হতেই বৃষ্টি নামলো। পৌষের বৃষ্টি। ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া ছাপিয়ে আপার শেষকৃত্য নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বৃষ্টি মাথায় করে খাটিয়াটা নিয়ে আমরা গেলাম কবরস্থানে। আপার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিলো, বৃষ্টির পানি পড়ছিলো সেখানে। কারা যেন উপর দিয়ে চাটাইয়ের ব্যবস্থা করে দিলো। বৃষ্টির পানি ঢোকা বন্ধ হলো তাতে। বৃষ্টি একটু ধরে এলে আপাকে ধরাধরি করে আমরা কবরে নামালাম। একমুঠো মাটি দেবার সময় মনে হলো, এই মুখটাকে আর দেখবো না। একটা মানুষ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সে যতোই আপন হোক, তাকে আর কাছে পাবো না আমি, কোনোদিনও‌ না।
দূরে কোনো এক জায়গায় প্যাঁচা ডাকছিলো। প্যাঁচার ডাকটা খুবই করুণ লাগছিলো আজকে। বাসার মানুষেরা কাঁদতে কাঁদতে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মা অনেকটা অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছেন, তাকে মহিলারা ভেতরের ঘরে নিয়ে বাতাস করছেন। বাবা চুপচাপ বসে আছেন। মোস্তাফিজ ভাই একধারে বসে ফোপাচ্ছেন। ঘরের পরিবেশটা অসহ্য লাগছিলো। মোস্তাফিজ ভাইকে বললাম, 'চলেন, একটু বাইরে যাই।' মোস্তাফিজ ভাই টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন। তাকে নিয়ে চললাম বাড়ির বাইরে‌।
বাইরেটা অন্ধকার। উঠোন পেরুলেই ধানক্ষেত, তার পাশেই খাল। আমরা খালের পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। আকাশে সুন্দর জোছনা।‌ জোছনায় চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
খালের পাড়ে একটা গাছের নিচে বসি আমরা। ঠান্ডা একটা হাওয়া বইছে। আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করি। মোস্তাফিজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দেই। তিনি একটা ধরান, আমি একটা। খাল পাড়ে বসে নীরবে সিগারেট টানতে থাকি আমরা।
সময় বয়ে যায় ধীরে ধীরে।‌ দূরে জোনাক পোকারা উড়ে যায়। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে মোস্তাফিজ ভাই বলেন, 'তোমার বোন এইভাবে চলে যাবে, ভাবতেও পারি নাই।'
আমি নীরবে সিগারেটে টান দেই। কিছু বলি না।
মোস্তাফিজ ভাই আরেকটা টান দেন সিগারেটে। মুখটা কুঁকড়ে আসে তার। বলেন, 'কান্নার মুখে সিগারেটও বেস্বাদ ঠেকে। তোমার বোন কত মানা করতো সিগারেট খেতে। শুনতাম না। আর এখন আমাকে মানা করার কেউ নাই। কেউ বলবো না, সিগারেট খাইয়া আসছেন, বাসায় ঢুকতে দিবো‌না আজকে।'
ভাই ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেষ। তার হাতের সিগারেটটা শেষ। আমি আরেকটা সিগারেট দেই তাকে। তিনি সেটাও টানতে থাকেন। দুঃখ ভোলার চেষ্টা হয়তো। তিনি দুটো টান দিয়ে আবার মুখটা কুঁচকে ফেলেন। এটাও মনে হয় বিস্বাদ লাগছে। কিন্তু তিনি সিগারেটটা ফেলেন না। একটু থেমে আবার টান দেন।
দূরে কোথাও ঘুঘু পাখি ডেকে উঠে। চাঁদটাকে ঢেকে দেয় কালো মেঘ। আশপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে যায়। আমি মোস্তাফিজ ভাইকে জিজ্ঞেস করি, 'আপা কেমনে মারা গিয়েছিলেন, আরেকবার বলবেন ভাই?'
ভাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকান। আমার কণ্ঠটা কি বেশি শান্ত শুনিয়েছে?
ভাই সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বলেন, 'তোমার আপা ঘরের পিছনে শাক তুলতে গিয়েছিলো। কলমি শাক। আমি বাড়ি ছিলাম না। বাড়ি ফিরে দেখি তোমার আপা নাই বাড়িতে। ডাকতে ডাকতে পিছনে গিয়ে দেখি...' বলেই তিনি ফুঁপিয়ে ওঠেন আবার। কথাটা শেষ করতে পারেন‌‌ না।
একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, 'ঘরের পিছে সাপ বাসা করেছিলো। কবে করেছিলো, জানি না। যদি জানতাম, আজ ওরে এইভাবে মরতে হতো না।'
কালো মেঘটা সরে গেছে। আবার চাঁদ উঁকি দেয় আকাশে। চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়।
আমি বলি, 'ভাই, আপার সাথে আমার প্রচন্ড ঝগড়া চলতো। এমনো গেছে, কোনো কোনো সপ্তাহ আমরা একজন আরেকজনের মুখও দেখি নাই। আপনি তো জানেন সবই, তাই না?'
ভাই মাথা নিচু করেই বলেন, 'জানি।'
আমি একটু চুপ করে থেকে বলি, 'কিন্তু এটা কি জানতেন, আমরা একজন আরেকজনের গোপন কথা জানতাম? এই পৃথিবীতে আমরা দুজনই কেবল দুজনকে বিশ্বাস করতাম, আর কাউকে না। এমন‌ অনেক কথা আছে দুজনের, যেটা বাবা মা জানতো না, কিন্তু আমরা জানতাম।'
মোস্তাফিজ ভাই অবাক চোখে তাকান। তিনি জানতেন না।
আমি বলতে থাকি, 'আপনার সাথে আপুর সম্পর্কের ব্যাপারটাও আমি জানতাম। অনেকদিন ব্যাপারটা আমি গোপন রেখেছিলাম, বাসায় কাউকে জানাইনি। পরে যখন ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলো, আব্বা মানা করে দিলো আপার সাথে আপনার বিয়ে দিতে, তখন আমিই আব্বাকে রাজি করিয়েছিলাম বিয়ের ব্যাপারে।'
আমি নীরবে সিগারেটে একটা টান‌ দেই। মোস্তাফিজ ভাই চুপচাপ বসে থাকেন‌। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছেন।
সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে আমি আবার মোস্তাফিজ ভাইয়ের দিকে তাকাই। বলতে থাকি, 'দুদিন আগে আপা আমাকে কল দিয়েছিলো। বলেছিলো আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আপা আমাকে একটা কথা বলেছিলো। তার ঘরে সতীন আসার গল্প। কোন এক বাইদ্যানি নাকি তার ঘরে সতীন হয়ে আসছে। কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ আপা খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে ছিলেন, মানুষের কানকথা শুনে ভেঙে পড়ার মতো মানুষ সে না। সবকিছু ভালোমতো জেনেশুনেই সে আমাকে ফোনটা দিয়েছে‌‌। আমি সব শুনে তাকে বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে, বাসায় কাউকে কিছু না জানাতে। আজকে আমি রওনা দিয়েছিলাম সকাল সকাল, বাসায় এসে ব্যাপারটা ভালোভাবে জানার জন্য। কিন্তু পথেই খবর পেলাম, সব শেষ।'
মোস্তাফিজ ভাই চুপচাপ বসে আছেন। তার হাতের সিগারেটটা এমনি এমনি জ্বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কি কিছু বলতে চান?'
ভাই মাথা নাড়লেন। বলবেন। কাতর স্বরে বললেন, 'একটা বাইদানির সাথে দুতিনদিন কথা বলেছিলাম। হাটে আমার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়াতো। এটা নিয়েই কে যেন কানকথা ছড়িয়েছে। তুমি এইসব কথা বিশ্বাস করো না।'
আমি নীরবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ি। তারপর বলি, 'আজকে আমি সকাল সকালই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় পৌঁছেছি রাত দশটায়। আমার তো বিকেলের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিলো। এতো দেরিতে কেন পৌঁছালাম, জানেন?'
মোস্তাফিজ ভাই মাথা নাড়লেন। তিনি জানেন না।
আমি বললাম, 'বেদেদের ঘুপড়িতে গেছিলাম। বেদেদের সর্দার, কালু, তার মেজো মেয়ের নাম বেলি। মেয়েটার সাথে একজনের বিয়ের কথা বললো। তার নাকি হাটে দোকান আছে। লোকটার যদিও একটা বউ আছে ঘরে, কালু সর্দার তাই লোকটার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন না। শেষমেষ লোকটা কথা দিয়েছে, একমাসের মধ্যেই ব্যাপারটার একটা সুরাহা হবে। একমাস তো লাগে নাই, আরো কম দিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সুরাহা হয়ে গেলো। তাই না ভাই?'
মোস্তাফিজ ভাই চুপ করে থাকেন। আমি বলে যাই, 'আপাকে ডিভোর্স দিলে বাবা আপনাকে ছাড়তো না। তিন তিনবারের চেয়ারম্যান তিনি, গ্রামে তার একটা প্রভাব আছে। তাই আপনি এই জঘন্য কাজটা করলেন। আপনার কি একটুও বুক কাঁপলোনা ভাই কাজটা করতে?'
মোস্তাফিজ ভাই এতোক্ষণ নতমুখে ছিলেন। হঠাৎ তার মুখটা পাল্টে গেলো। কান্নাভেজা দুঃখ ভারাক্রান্ত মুখের জায়গায় সেখানে প্রচন্ড ক্রোধ, আর সতর্কতার ছাপ। কারো চোখে যে এতোটা ধূর্ততা ফুটে উঠতে পারে, আমার জানা ছিলো না।
ভাই রাগী গলায় বললেন, 'তুমি কি আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করতেছো? নাইলে এইসব আজব গালগল্প কেমনে ফাদলা? সাপে কাটা মানুষকে আমি কেমনে মারুম? আর কালু সর্দার নামে কাউরে আমি চিনি না। তুমিই কাউরে টাকা খাওয়াইয়া এসব কথা বলাচ্ছো আমার নামে। তোমার আর তোমার বোনের শত্রুতার কথা তো আমরা সবাই জানি। ঐদিন তোমার সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকেই তার মনটা খারাপ। তুমি ঠিকই ওরে উল্টাপাল্টা কিছু বলছো, যাতে ও কষ্ট পাইছে। আর সেই কষ্টের জন্য আজকে সাপের গর্তে পা দিছে। তুমি জানো সব বিষয়। জানো বইলাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমার নামে উল্টাপাল্টা অপবাদ দিতেছো।'
আমি মুচকি হাসি। হেসে সিগারেটে টান দেই।‌একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে মোস্তাফিজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলি, 'আমার সাথে এমনে খেলে লাভ নাই ভাই।‌আপনি এমনিই খেলায় হেরে বসে আছেন। কালু সর্দারের তাবু থেকে গতকাল একটা সাপ খোয়া গেছে। চন্দ্রবোড়া সাপ। সাপটার বিষ দাঁত এখনো ভাঙা হয় নাই। আপুকে তো চন্দ্রবোড়া সাপই কেটেছে, তাই না?'
মোস্তাফিজ ভাই সরু চোখে তাকিয়ে থাকেন। তিনি হয়তো মাপার চেষ্টা করছেন, আমি আসলে কতোটুকু জানি । কিন্তু তিনি রণে ভঙ্গ দিবেন না। কঠিন মানুষ তিনি। তিনি যে এতো জঘন্য ধূর্ত এক মানুষ, আজকের আগে ধারণাই করতে পারিনি।
তার মুখে হঠাৎ অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, 'কোথায় কোন সাপ হারাইছে, এইটার জন্য তুমি আমারে দায়ী করবা? কেমনে? এইটা কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে?'
আমি বলি, 'না, পড়ে না। আমি খালি মার্ডার ওয়েপনটার কথা বললাম।‌এবার আরেকটা কথা বলি। আপা যে আজকে কলমি শাক তুলতে ঘরের পেছনে গেছিলো, এটা আপনি কিভাবে জানলেন? সে সময় তো আপনি ঘরে ছিলেন না।'
মোস্তাফিজ ভাই বললেন, 'না, ছিলাম না। কিন্তু সকালে সে আমাকে বলেছিলো, তার কলমি শাক খেতে ইচ্ছা করছে। তাই ধারণা করেছিলাম, সে কলমি শাক তুলতেই ঘরের পিছনে গেছে।'
'কলমি শাক খেতে ইচ্ছা করছে, এটা কি আপা নিজে আপনাকে বলেছেন?'
'হ্যাঁ।'
আমি মুচকি হেসে বলি, 'আপা কলমি শাক খেতো না। কলমি শাকে আপার এলার্জি ছিলো।'
মোস্তাফিজ ভাই বজ্রাহত পথিকের মতো বসে থাকেন। আমি বলি, 'আপনি বেদেদের বাড়ি থেকে সাপটা চুরি করেন। খুব সম্ভবত বেলিই আপনাকে সাহায্য করে সাপটা চুরি করাতে। আজকে আপা যখন সকালে ঘুমিয়ে ছিলো, আপনি তখন তার পায়ে সাপটা ছেড়ে দেন। সাপের ছোবলে আপা মারা যাওয়ার পর আপার লাশটা নিয়ে রেখে আসেন ঘরের বাইরে। পরে নিজে ঘরের বাইরে চলে যান। বাইরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এসে ঘরে ঢুকে এমন মাতম শুরু করেন, যে ঘরে ঢুকেই আপার লাশটা দেখতে পেয়েছেন। বাইরের লোকজনও ঘরে ঢুকে বিশ্বাস করে আপনার কথা। লাশের পোস্টমর্টেম নেই, তদন্ত নেই, আপনাকে ধরারও কেউ নেই। তাই না?'
মোস্তাফিজ ভাই চুপচাপ বসে থাকেন।‌এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ফেললেন।‌প্রাণখোলা হাসি।‌হাসি থামিয়ে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'হ, কোনো প্রমাণ নাই, প্রমাণ করারও কেউ নাই। তোমার মুখের কথা কেউ বিশ্বাস করবো না। সবাই বলবো আপা মারা যাবার কষ্টে উল্টাপাল্টা গল্প বানাইতাসো। এখন তুমি আমারে কেমনে ধরবা?'
আমি সামনের দিকে তাকাই‌। সামনে খালপাড়ে বড় বড় গাছের সাড়ি। চাঁদের আলো মেঘে ঢেকে গেছে, এদিকটা অন্ধকার। গাছের সাড়ির ঘন ছায়ায় জায়গাটা কেমন রহস্যময় হয়ে গেছে। দেখলেই গা ছমছম করে।
আমি মোস্তাফিজ ভাইকে বলি, 'একটা উপায় আছে। আপনি নিজের মুখে সব স্বীকার করে ফেলবেন সবার সামনে। তাহলেই সবাই বিশ্বাস করবে।'
মোস্তাফিজ ভাইয়ের চোখে কৌতুক খেলা করে, 'তুমি কি আমাকে বলদ পাইসো? আমি কি এমনি এমনি সবকিছু সবার কাছে গিয়ে বলে দিবো? তার চাইতে তুইও চেপে যা।‌তুই জানোস না কতো জায়গায় আমার কতো বন্ধুবান্ধব আছে। এমন জায়গায় তোরে পুইতা রাইখা দিবো, কেউই জানবো‌ও না।'
আমি শান্ত চোখে মোস্তাফিজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলি, 'এতোকিছু করতে হবে না। আপনি‌ নিজের মুখেই সবকিছু স্বীকার করবেন। আজ রাতেই করবেন।‌এর কারণ, আজ রাতেই আপা আসবে আপনার কাছে। যেকোন সময়। হয়তো এখনই। আর আসার সাথে সাথেই, সে আপনার উপর প্রতিশোধ নিবে। ভয়ংকর, কঠিন প্রতিশোধ। যে প্রতিশোধ থেকে বাঁচার উপায় আপনার নাই।'
মোস্তাফিজ ভাই হো হো করে হাসতে থাকেন। পাগলের মতো হাসি। হাসতে হাসতে তার হেঁচকি উঠে যায়। তিনি থামেন। সামনের রহস্যময় অন্ধকারের দিকে তাকান। আর তখনই, তার মুখের ভাবটা পাল্টে যায়।
সামনের অন্ধকারটুকু আরো গাঢ় হয়েছে।‌ ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ থেমে গেছে অনেক আগেই। চারদিক নীরব হয়ে গেছে। এরমধ্যেই মোস্তাফিজ ভাই চিৎকার করে উঠেন। ভীষণ ভয়ে মরণ চিৎকার। তার দৃষ্টি সামনের রহস্যময় অন্ধকারের দিকে। সেখান থেকে কেউ এগিয়ে আসছে তার দিকে।
ভাই চিৎকার করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। তার চিৎকার থামে না। তিনি চিৎকার করতে করতেই দাঁড়িয়ে যান। সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে যান। চিৎকার করে বলতে থাকেন, 'আমি সবাইকে সব বলে দিবো। সব বলে দিবো। আমারে মাইরো না।'
ভাইকে যে সিগারেটটা আমি দিয়েছিলাম, সেটা তার কাছে এমনি এমনি বিস্বাদ লাগেনি। তার ভেতরে ছিলো ড্রাগ, ভয়ানক হ্যালুসিনেটিং ড্রাগ। আমি যে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে চাকরি করি, সেখানে এই ড্রাগটা ম্যানুফ্যাকচার করা হচ্ছিলো কয়েকদিন যাবত। সুযোগ বুঝে আমি কিছুটা সরিয়ে ফেলেছিলাম। আজ আসার পথে সেটা নিয়েই আসছিলাম, ভেবেছিলাম এটা খাইয়েই তাকে ভয় দেখাবো দ্বিতীয় বিয়ে না করার জন্য। কিন্তু এর আগেই যে সব শেষ হয়ে যাবে, ভাবতেও পারিনি।
মোস্তাফিজ ভাই সব স্বীকার করে ফেলবে সবার সামনে। তার শাস্তি হবে। কিন্তু আপাকে তো আর আমি ফেরত পাবো না। আমি চুপচাপ বসে থাকি খালপাড়ে। পৌষের ঠান্ডা বাতাস আমার কপাল ছুঁয়ে যায়, আপার হাতের পরশের মতো। আমার খুব কান্না পায়, খুব। সকালের শুকনো চোখটা এখন ভিজে আসে। কান্নার সিক্ত ধারা নেমে যায় আমার গাল বেয়ে।

গল্প - সিক্ত
লেখা- সোয়েব বাশার
তারিখ- ১৮ জুন, ২০২৪ ইং


No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...