Thursday, July 4, 2024

মায়ের ভাঙা চশমা


অফিসে আমি তখন বড় আপা কল দিয়ে বললেন, তুই কি আজকে আমাদের বাসায় আসতে পারবি? আমি জিজ্ঞেস করলাম কখন? আপা বলল, দুপুরে চলে আয় পারলে তোর বউ বাচ্চাদের নিয়ে। না আপা, দুপুরে পারবো না সন্ধ্যায় আসি। আপা বলল, আচ্ছা সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি আসিস, তোর দুলাভাই আজকে বাসায় থাকবে সন্ধ্যায়।
 
যাক এইভেবে ভালো লাগছে সন্ধ্যায় দুলাভাইয়ের সাথে দুর্দান্ত একটা আড্ডা হবে। এই মানুষটার সাথে আমার আড্ডা জমে, থাকে না কিছু মানুষ যাদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, কথা ফুরায় না, যাদের পাশাপাশি থাকলে মনে অন্যরকম এক উৎফুল্ল ভাব থাকে দুলাভাই আমার কাছে তেমন মানুষ।
আপার বারবার কল দেওয়ার অবশ্য একটা কারন আছে। আম্মার একটা চশমা যা আমার কাছে আছে গত একমাস ধরে। আমাদের জন্যে আব্বা আম্মার রেখে যাওয়া কোনো সম্পদ ছিলো না, আব্বা তাঁর গ্রামের জমি বিক্রি করে শহরের ব্যবসা শুরু করেন। আব্বা মারা যাবার পরে সেই ব্যবসার যাদের সাথে শেয়ারে ছিলো তাঁরা সব টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আমার মা অবশ্য একটা মামলা করলো, কিন্তু আমরা এক পয়সাও পেলাম না। মা একসময় থানায় দৌড়াদৌড়ি করা ছেড়ে দেয়।
 
আব্বার অল্পকিছু জমান টাকা ছিলো, তখন শহরে আমরা ভাড়া বাসায় থাকি। আব্বা চলে যাওয়ার পরে যেহেতু আমাদের সংসারে আয় করবার মতো কেউ ছিলো না, যার কারনে সেই বাসা ছাড়তে হয়। মা আমাদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে একট এক রুমের বাসায় উঠে। আপার আর আমার একসময় আলাদা রুম ছিলো এখন আমরা সবাই এক রুমেই থাকি।
 
আব্বার বন্ধু নিজাম কাকা মাকে একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি দিয়ে দেন। মায়ের স্কুলের বেতনের টাকায় সংসার চালানো অনেক কষ্ট হয়ে গেলো, তখন মা স্কুল ছুটি পরের বিকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত টিউশন পড়াতেন। আপা তখন ক্লাস এইটে পড়ে, আমি ফাইভে; দুজনের পড়াশোনার খরচ, সংসারের খরচ, এই এক রুমের ঘরটার জন্যে দুই হাজার ভাড়া দিতে হতো— এই সবকিছু মায়ের একার আয়ে চলতো।

মায়ের হঠাৎ একবার চোখে সমস্যা হয়, তখন ডক্টর দেখিয়ে চশমা নিতে হয়। এর কিছুদিন পরেই আপার হাত থেকে পরে মায়ের চশমার ডাট ভেঙে যায়, আপা সেদিন ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে গেলো। আমি ভেবে নিছিলাম মা আপাকে কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিবে। কিন্তু মা আপাকে কিছুই বললো না, মাকে দেখলাম চশমার ফ্রেমের সাথে ভাঙা ডাট গুনা দিয়ে বেঁধে নিছেন। এই চশমায় খরচ হয়েছে চার হাজার টাকা, এখন ফ্রেম কিনতে গেলে বাড়তি টাকার দরকার, মা টাকা বাঁচাতে সেই ভাঙা ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়েই কাটিয়েছেন।
 
স্কুল, কলেজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আপা পড়তেন জাহাঙ্গীরনগর। যদিও আমার জাহাঙ্গীর নগর চান্স হলো না। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাবজেক্টে আমি ভর্তি হই। আমরা দুই বোন তখন টিউশন করে পড়াশোনার খরচ চালাই। বেশ কয়েক মাসের টিউশনের টাকা থেকে অল্প অল্প টাকা জমিয়ে ভেবে রেখছিলাম মাকে একটা চশমা কিনে দিবো।
 
হঠাৎ একদিন আপার একটা ফোন আসে, আপা তখন মায়ের কাছে থেকেই চাকরির জন্যে পড়ছে। আপা কান্নাভেজা কন্ঠে বলেন, বাবু মা আর নেই। বাড়িতে আম্মা আর আপা দুজনেই আমাকে বাবু ডাকতেন, নামধরে কখনো ডাকতেন না। আমার মনে হলো গোটা পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছে, চশমা কেনবার টাকা দিয়ে মাকে একটা ট্রাকে করে গ্রামে নিয়ে যাই।
 
আমাদের জন্যে মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদ বলতে ছিলো একটা ভাঙা ফ্রেমের চশমা, যা মায়ের শেষ সময় পর্যন্ত চোখে ছিলো। চশমটা এখন আপার কাছে কিছুদিন থাকে, আবার আমার কাছে কিছুদিন থাকে।
সুদিন আমাদের এসেছে, আপার একটা কলেজে চাকরি হয়েছে, আমর চাকরি হয়েছে। তবে আমার মা যে কিনন ফুলের বিছানা থেকে নেমে দুই সন্তানকে নিয়ে অমসৃণ পথে হেঁটেছেন সে দেখে যেতে পারলো না সুখ, এই এক আপসোস। মধ্যবিত্ত, নিম্মমধ্যবিত্ত পরিরবারের সন্তানরা যখন মা বাবার পছন্দ পূর্ণ করবার মতো সামর্থবান হয় তখন মা বাবা অনেক দূরে চলে যায়।

সন্ধ্যাবেলা আমি যখন আপার বাসায় গেলাম, আপা বলল বাবু চশমা নিয়ে এসেছিস? আমি চশমার বক্সটা আপার কাছে দিলাম। আপা যলদি করে বাক্সটা খুলে এমনভাবে চশমায় স্পর্শ করলেন যেনো বহুদিন পরে মায়ের গালে আপা হাত রাখছেন, আপার মুখ বিষণ্ণ, আপার চোখে দেখলাম কয়েক ফোঁটা পানি, যেনো শিশির জমা ঘাস। আপার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে আমার চোখে পানি জমে গেলো টের পেলাম না।
 
-মুস্তাকিম বিল্লাহ

source: https://www.facebook.com/100076064586343/posts/495441839667965/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...