Saturday, September 28, 2024

মুই রাধা মইরা যাইমু

 মলয়বাবু গলাটা আস্তে করে বললেন -"ফোনটা কাটলে কেন?"

সরলাদেবী আগের থেকে গলায় একটু জোর এনে বললেন " বৌমা আপিস বেরাচ্ছিল,টিফিনটা দিলাম!"
মলয়বাবু একটু মজা করে বললেন " তাই গলায় এতো জোর!"
সরলাদেবী খিলখিল করে হেসে বললেন " লজ্জা লাগে না এই বয়সে এরকম ফোনে কথা বলতে!" মলয়বাবু বললেন " এই বয়সে প্রেম করতে ভালোই লাগে বলো!"সরলাদেবী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছেন। ফোনের ওপার থেকেই মলয় বাবু বেশ বুঝতে পারছেন সেটা!
এই লজ্জায় লাল মুখটা দেখতে বড্ড ভালোবাসতেন মলয়বাবু ।সরলাদেবী অল্প বয়সে কথায় কথায় লজ্জা পেতেন । চোদ্দো বছরের ছোট ছিলেন সরলাদেবী মলয়বাবুর থেকে।বাচ্চা বউ - আদরে, আবদারে বুকে আগলে রাখতেন।
মলয়বাবু খেয়াল করলেন ওপাশে সরলাদেবী চুপ। " কি গো শুনছো? " সরলাদেবী বললেন " হমম " মলয়বাবু বললেন " চুপ কেন? " সরলাদেবী আলতো করে বললেন " রান্না করছি তো, কানে ফোন দিয়েই রান্না করছি!এক্ষুনি দিদিভাই আসবে স্কুল থেকে, এসেই খিদে পেয়ে যায় ওর !"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলয়বাবু বললেন " কত খাটনি হয় তোমার না গো?" সরলাদেবী গলায় আদর এনে বললেন " তুমি ফোন করলেই সব ক্লান্তি চলে যায়।, আর রান্না করতে ভালোই লাগে। আরও ভালো লাগে যখন ওরা খেতে বসে থালা চাটে!"
আজ তিনদিন হলো বুকে বড্ড ব্যথা। রাতে ঘুষঘুসে জ্বর আসে। কিচ্ছু কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু করতেই হবে। কেউ জোর করেনি,সরলাদেবী নিজের থেকেই করেন। ডাল টা নামিয়ে কড়াই বসালেন মাছের ঝোলটা করবেন বলে!এটুকুতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। আর কানে চেপে কথাও বলতে পারছেন না। তাই বললেন " শোনো না ফোনটা রাখি, তুমি ওষুধ গুলো ঠিকঠাক খেও,শেষ হওয়ার আগেই ছোট খোকাকে বোলো, নিজের যত্ন নিও!
ফোনটা রেখে চেয়ারে এসে বসে পড়লেন মলয় বাবু।মাস আটেক আগে স্ট্রোক হলো সেই সুযোগ নিয়ে ছেলেগুলো ভাগ করে দিল দুজনকে ! একসাথে দুজনকে রাখা সম্ভব নয় ওদের।বড় ছেলের বউ চাকরি করে আট বছরের মেয়ে আছে তাই মাকে ওদের চাই। আর বোকা মা সেই আবদার ফেলতে পারেনি। আর ছোটটার সদ্য বিয়ে হয়েছে। তাই বাবা ওখানেই থাক।সুন্দর ব্যবস্থা।
এই ছেলেদেরকেই নাকি দুজনে মিলে ভিটে, মাটি, টাকা শেষ করে মানুষের মত মানুষ করেছেন! বুকটা ভার হয়ে গেল মলয়বাবুর। ইচ্ছে করে এক ছুট্টে যায় বড় খোকার বাড়ি একবার দেখে সরলাদেবীকে।
এতটা অসুস্থ ছিলেন মলয়বাবু তাই জোর করে বলতেও পারেননি যে " আমি তোদের মা কে ছাড়া থাকতে পারবো না!" আর কোন ভরসায় বলতেন, কি ছিল ওনার জীবনে। যেটুকু সম্বল ছোট খোকার ইঞ্জিনিয়ারিং য়ের সময় শেষ!থাক তাও শেষ বয়সে সরলা মাছ টা দুধ টা পায় ওখানে!
( বাবা গরম জল দিয়েছি বাথরুমে )
ছোট বৌমার চিৎকারে চেয়ার ধরে উঠে পড়লেন মলয় বাবু।
****
"বাবা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠো দাদা ফোন করেছিল মায়ের নাকি শরীর ভালো নেই। "- মলয়বাবু শুনছেন দরজায় দাঁড়িয়ে ওনার ছোট ছেলে রথীন বলছে। আজ আট মাস এ বাড়িতেই আছেন উনি, একা। আর ওনার অর্ধাঙ্গিনী বড় ছেলের বাড়িতে। এখান থেকে ঘন্টা তিনেকের পথ।
" বাবা ওঠো তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে!" রথীনের কথায় ধৰ্মড় করে উঠে বসলেন মলয়বাবু। তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলেই বললেন " বেঁচে আছে নাকি শেষ? "
"তুমি কি পাগল নাকি? সুস্থ মানুষ একটু শরীর খারাপ হয়েছে,তোমায় দেখতে চাইছে!আর কিসব কথা বলছো তুমি?" - ধমক দিয়ে বললো রথীন।
" সেই তো, সেই তো, সুস্থই তো ছিল তোদের মা, অসুস্থ তো আমি, এমন হাভাতে অসুখ! সব শেষ করে দিলো আমার, বুকটা খালি করে দিলো!"- একা একাই বলে যাচ্ছেন মলয়বাবু।
রথীন বাবাকে ধরে বললো " বাবা শান্ত হও,নিজেকে শান্ত করে তৈরী হও, এক্ষুনি বেরোবো, মা তোমাকে দেখতে চাইছে!" - বাবাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রবীণ। ছেলের কাঁধে মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন মলয় বাবু। এতো বড় অসুখের পর উনি আছেন ঠিকই কিন্তু ওনার অর্ধেকটাই তো নেই!
*******
যতীনের বাড়িতে ঢুকতেই মলয়বাবুর নাকে ধূপকাঠির গন্ধ আসলো। উনি বুঝে গেছেন সবটাই।তাও আশা নিয়ে মনে শক্ত করে গাড়ি থেকে নামতেই বড় খোকা যতীন ছুটে এসে বললো " বাবা এতো দেরী কেন করলে, কতবার তোমার নাম ধরে ডাকলো!"
তারপর রথীনকে জড়িয়ে বললো " ভাই সময় দিল নারে!" মলয়বাবু ঘরে গেলেন না। বাইরেই সোফায় বসে পড়লেন। হাত পা কাঁপছে। ওখান থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন এক মাথা সিঁদুরে, লাল শড়িতে নতুন বউ লাগছে সরলা কে। সেই আজ থেকে বাহান্ন বছর আগের আঠেরোর সরলা। সারাদিন নুপুর পরে ঝুমঝুম করে ঘুরে বেড়াতো খিলখিল করে হাসতো।কানে চাপা দিলেন মলয়বাবু। চোখ বন্ধ করে আছেন।
নাতনি এসে বললো " দাদুভাই ঠাম্মি এটা দিতে বলেছে তোমায়!"লুকিয়ে টিয়া একটা কাগজ দিল মলয়বাবুকে।
মলয়বাবু কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ খুলে দেখলেন তাতে লেখা -
"কইয়োরে ভ্রমর,কৃষ্ণরে বুঝাইয়া-
মুই রাধা মইরা যাইমু কৃষ্ণহারা ।"
(একটা ছোট গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল লেখাটা। )
🖊অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা

source: https://www.facebook.com/100083232380990/posts/529774529806955/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...