Saturday, September 7, 2024

সে আমার ছোট বোন

 মলি আমার স্ত্রী।

গতকাল সন্ধ্যায় টয়লেট থেকে বের হয়ে দেখি মলি আমার মোবাইল ফোন ঘাটছে। আমাকে দেখে সে থতমত খেয়ে যায়।
আমি নির্বিকায়।
অত:পর পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য আমি গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি,
আমার সাদা দিলে কাদা লাগাই গেলি
চাতুরী করিয়া মোরে বান্ধিয়া পিরিতের ডোরে
বিচ্ছেদের সাগরে ভাসাই গেলি রে বন্ধুয়া।
মলি চোখ গোল গোল করে টিভি স্ক্রীনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। আমি সরাসরি মলির দিকে না তাঁকিয়ে টিভি, ফ্যান, দেয়ালের লোভাতুর টিকটিকি, তারপর মলি। এভাবে কয়েকবার তাঁকাই।
এটা ঠিক যে, কয়েকটাদিন অফিস থেকে বের হতে আমার দেরী হয়েছে এবং মোবাইল ফোনে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই সময় কাটিয়েছি। কিন্তু তার পেছনে তো সঠিক কার্যকারণ আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু তা না করে এভাবে মোবাইল ফোন ঘাটাঘাটি সত্যই আমাকে কষ্ট দেয়। তবুও আমি নিজেকে চেপে যাই। কেননা আমি তাকে ভালেবাসি এবং আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা অর্জন করবার মতো সকল যোগ্যতাই তার রয়েছে।
কিছুটা সময় আমরা কেউ কথা বলিনা। অনেকদিনই এমনটা হয় যখন আমরা কারন ছাড়াই কোন কথা বলিনা কিংবা চুপ করে থাকতে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু আজকের চুপ করে থাকাটা আমার কাছে বেশ ওজনদার মনে হয়।
অত:পর সকল নি:স্তব্ধতা ছিন্ন করে মলি বলে,
: এই যে এভাবে তোমার ফোন ঘাটলাম আমাকে তো কিছু বললে না ?
: কী বলবো!! হয়তো কোন প্রয়োজন বোধ করেছ ?
আবার নিরবতা। মনে হয়, প্রায় দুই হাত দূর হতে আমি মলির হৃদপিন্ডের ধক্ ধক্ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি ভাবি, এটা বড় কোন ঝড়ের পূর্ব সংকেত নয় তো?
: ফারজানা কে ?
: জুনিয়র কলিগ। গত মাসে জয়েন করেছে।
: সে তোমাকে ‘তুমি’ করে বলে ?
: হুম। বিষয়টা আমাকেও বিব্রত করছে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
: তোমাকে বিশ্বাস করতে আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। কেননা তোমাদের Conversations সে রকম সাক্ষ্য দিচ্ছে না।
: শব্দটা বোধহয় Conversations হবেনা।
: কেন ?
: কেননা আমি ফারজানার একটা Message এর উত্তরও দেইনি।
২.
গতমাসে ফারজানা আমার ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা টগবগে তরুণি। এটাই তার প্রথম চাকরি। কাজ শিখতে তার প্রবল আগ্রহ। পারলে সাতজনের কাজ একাই করেন। যখনই কোন কাজে আটকে যায় চোখ বন্ধ করে আমার ডেস্কে চলে আসে। আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি একটু ধীরে চলুন। সে খিলখিলিয়ে হাসে। অনেকটা সময় নিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে তার চোখ সজল হয়ে উঠে।
আমি সরাসরি তার দিকে তাঁকাতে পারিনা কিংবা তাঁকাই না।
আমি বুঝতে পারি আশেপাশের কয়েকজোড়া প্রশ্নবোধক চোখ এরমধ্যে আমার ডেস্কে এসে স্থির হয়েছে। এবার আমি থামি কিংবা আমাকে থামতেই হয়।
কিন্তু ফারজানা থামেনা। সে কারণে, অকারণে আসে। বারে বারে আসে।
এরমধ্যে আমাকে অন্য আরেকটি বিভাগের প্রধান করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই আমার ডেস্ক পরিবর্তন হয়। বেড়ে যায় ব্যস্ততা। এরপরও ফারজানা আসে।
একটা কাজ বুঝিয়ে দিতে দিতে বলি,
ফারজানা, অনেকদিন তো হলো এখন নিজে নিজে চেষ্টা করুন। এরপরও আটকে গেলে আপনার বিভাগের সিনিয়রদের কাছ থেকে বুঝে নিন।বুঝতেই তো পারছেন নতুন বিভাগ, নতুন কাজ, অধিক ব্যস্ততা।
এরপর সাতদিন ফারজানা আমার কাছে আসেনি। একদিন বিকালে ফোন করে ফারজানা বলে,
শাহরিয়ার ভাই তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার। একটু সময় দিতে পারবে ?
আমি সম্মতি দিয়ে ফোন রাখি। ফারজানা কী আমাকে ‘তুমি’ করে বললো? আমি কী কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছি ?
বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। কাজ শেষ করতে পারিনা। ফারজানা লাগাতার এসএমএস দিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষ আমরা একটা কফিশপে বসি।
: শাহরিয়ার ভাই আমি জানি তুমি বিবাহিত এবং তুমি তোমার বর্তমান জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া মানুষ। নিজেদের শিক্ষিত এবং আধুনিক মানুষ হিসেবে দাবী করি। অথচ একটা মেয়ে কোন ছেলের সাথে হাসিমুখে কথা বললেই আমরা তাদের মধ্যে প্রেম খুঁজি । একজন বাবা কী তার মেয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলেনা কিংবা একজন ভাই তার বোনের সাথে?
: আমাকে এসব কথা বলছেন কেন?
: কেননা তুমি আমার সাথে সহজ হতে পারোনা। আমি তোমার চেয়ে এতো ছোট হওয়ার পরেও তুমি আমাকে আপনি করে বলো। আমি এও জানি তুমি সচেতন ভাবেই আমাকে এড়িয়ে চলো। তবে তুমিই প্রথম নও।
: ‘তুমি’ কোন অফিসিয়াল ভাষা হতে পারেনা।
: তোমার ছোট ভাই কিংবা বোন যদি তোমার অফিসে চাকরি করতো তখন তুমি কী করতে ?
: সে বিষয়টা ভিন্ন। কিন্তু তুমি তো আমার বোন নও। আর আমি পাতানো ভাই-বোন সম্পর্কে বিশ্বাসী নই। কেননা এ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা মধুর নয়।
এরপর তিন-চারদিন ফারজানার কোন খোঁজ নেই। ফোনও করেনি। আমি ওর ডেস্কে গিয়ে জানতে পারি ফারজানা পারিবারিক কারণে দশদিনের বিশেষ ছুটি নিয়েছে। আমি ইচ্ছা করলেই ফোন দিতে পারি। কিন্তু আমি থেমে যাই।
৩.
শুক্রবার সকাল বেলা। আমরা নাস্তা করতেছি। ডোরবেল বেঁজে উঠে। মলি দরজা খুলতেই একজন বয়স্ক মহিলা বলেন, এটা কী শাহরিয়ারদের বাসা?
মলি উনাকে সাথে করে নিয়ে বাসায় ঢুকেন। ভদ্রমহিলার হাতে একটা প্যাকেট।
: আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না!
: আমি ফারজানার মা।
মলি আমার দিকে রহস্য ভরা চোখে তাঁকায়।
চায়ের কাপে ঠোঁট লাগাতে লাগাতে তিনি বলেন,
আগামি সোমবার ফারজানার বিয়ে। তোমাদের নিমন্ত্রণ দিতে এসেছি। ফারজানা তোমার সম্পর্কে আমাকে সব বলেছে। বাসায় আর কোন মানুষ না থাকায় আমি আর ফারজানা বন্ধুর মতো চলি। ওর আচরণে তোমার আগে আরও কয়েকজন বিব্রত হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে থামাতে পারিনা। তুমি ওকে ক্ষমা করে দিও।
: এভাবে বলবেননা প্লিজ। ও তো আমার সাথে কোন অপরাধ করেনি।
: ফারজানার তিন বছরের বড় একটা ভাই ছিলো। ওর নামও ছিলো শাহরিয়ার। আমি আমার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। শাহরিয়ার ফারজানাকে আগলে রাখতো। আমার ছেলেটা অনেক মেধাবি ছিলো। ফারজানা তখন কলেজে পড়ে। মহল্লার কয়েকটা বখাটে ছেলে ফারজানাকে বিরক্ত করতো। যে কারনে শাহরিয়ার ওকে কলেজে আনা-নেয়া করতো। একদিন শাহরিয়ার ব্যস্ততার কারনে ফারজানার সাথে যেতে পারেনি। ফারজানা কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে আসে। আমি তখন স্কুলে ছিলাম। শাহরিয়ার প্রতিবাদ করতে ছুটে যায়। সেই যে গেলো আর জান নিয়ে ফিরে আসেনি। চারদিন পর নদীতে ওর লাশ ভেসে উঠে।
মলি হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি মলিকে থামাই না। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে তাঁকাই। দুইটা ছোট ছেলে-মেয়ে খেলছে। আমার খুউব জানতে ইচ্ছে করে ওরা কী ভাই-বোন? নাকি প্রতিবেশী?
ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে চারদিনের ছুটি নিয়ে আমি অফিস থেকে বের হয়ে আসি। মলিও তার ননদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফারজানার সাথে এ মার্কেট থেকে সে মার্কেটে যাচ্ছে। আমারও কত কাজ জমে আছে। ডেকোরেটর ঠিক করতে হবে। বাবুর্চির সাথে বসতে হবে।
অনেকগুলো কাজ শেষ করে আমরা মধ্যরাতে রিক্সায় উঠে
বসি। মলি আমার হাত শক্ত করে ধরে। আমার সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। মলি গুনগুনিয়ে বলে। বারেবারে বলে,
‘মোর করতল তব করতলে হারা’

জিবন চক্রবর্তী

https://www.facebook.com/100048712637561/posts/1107046170929127/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...