Saturday, September 7, 2024

জানালার পাশে কাঁদছে একটা মেয়ে

 ‘আগামীকাল সকাল সাতটায় আমাকে ইস্টিশনে পৌছে দিতে পারবি?’

‘হ্যাঁ পারবো।’
‘আচ্ছা ভোরে আমার বাসার সামনে রিক্সা নিয়ে চলে আসবি কয়েকটা ব্যাগ আছে।’
‘আচ্ছা আসবো।’
নাদিয়া আপা কল কেটে দিলেন। যদিও আমার সকালে ঘুম থেকে উঠবার অভ্যেস নেই, কিন্তু নাদিয়া আপাকে না করা যায় না। একা মানুষ যাবে, হয়তো বেশি ব্যাগ যার কারনে আমাকে ডেকেছে নয়তো কিছুতেই বলতেন না।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হল থেকে বের হলাম, নাদিয়া আপার বাসা আমার হল থেকে দশ মিনিট হাঁটলেই। একটা রিক্সা নিয়ে নাদিয়া আপার বাসার কাছে এসে দাঁড়ালাম। আপাকে কল দিলে বলল, উপরে চলে আয়।
আমি তিনতলায় উঠে নিচে ব্যাগ নামিয়ে নিলাম। এতো ব্যাগ দেখে মনে হলো নাদিয়া আপা একেবারে শহর ছেড়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কি আসবেন না? নাদিয়া আপা বলল না।
আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করবার সাহস হলো না। রিক্সা নিয়ে ইস্টিশনে এসেছি, ট্রেন আসতে এখনো বিশ মিনিট বাকি। নাদিয়া আপা বলল, তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? আমি বললাম এইতো চলছে একরকম, বই টই পড়তে ভালো লাগে না মন চায় ঘুরে পুরো দেশ। আপা হেসে বলল, তাইলে ঘুরা শুরু কর এখনি, এই বয়সে অবশ্য মাথায় এমন পাগলামি বুদ্ধি চাপে।
নাদিয়া আপার মুখের হাসি দেখে খারাপ লাগছে, মনে হচ্ছে আপা নিজের বিষণ্ণতা লুাকাতে জোর করে হাসছেন।
নাদিয়া আপা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেন। নাদিয়া আপার বিয়ে হয়েছে তিনমাস হয় জাবেদ ভাইয়েে সাথে। আমার হলের দুইশো তেরো নাম্বার রুমে জাবেদ ভাই থাকেন, তার পাশের রুমেই আমি থাকি। সেই থেকে জাবেদ ভাইকে চিনি।
জাবেদ ভাই আর নাদিয়া আপার চার বছরের সম্পর্ক, তারপরে বিয়ে করেন। বিয়ের সময় শুধু সতজন মানুষ উপস্থিত ছিলো, নাদিয়া আপার দুজন বান্ধবী, আমি আর জাবেদ ভাইয়ের দুই বন্ধু।
নাদিয়া আপার পরিবার থেকে বিয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছে, তাকে বাড়ি থেকে জানিয়ে দিয়েছে এবার বাড়িতে গেলেই তার বিয়ে হবে। ছেলেপক্ষ নাদিয়া আপাকে এর আগে দেখেছে, মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। নাদিয়া তার পরীক্ষার কথা বলে বাড়িতে যায়নি, ঠিক করে রেখেছে বেশি জোরাজোরি করলে বিয়ের কথা জানাবে। তখন আর বিয়ে দিতে পারবে না।
নাদিয়া আপা আর জাবেদ ভাই বসতেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের পাশের পদ্ম পুকুরের বেঞ্চ, প্রায় সময় ইচ্ছে করে তাদের জ্বালাতন করতাম। পরে জাবেদ ভাই আমাকে থামাতে কখনো বিশ টাকা বা ত্রিশ টাকা দিতো। সিগারেট আর চা খরচা হয়ে যেতো।
সেদিন দুপুর বারোটার দিকে জাবেদ ভাই হল থেকে ছাত্রদের সাথে মিছিলে বের হয়, বেশ কিছুক্ষণ আমরা পাশাপাশি ছিলাম। এর ভিতরেই পুলিশ মিছিলকে উদ্দেশ্য করে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে, শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি, যে যেভাবে পারছি বিল্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়েছি।
পুলিশ একসময় গুলি চালায় ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে, আমার চোখ মুছতে মুছতে গ্যাসের কারনে লাল হয়ে গেছে। অনেকসময় পরে স্বাভাবিক হয়। কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, যে যাকে যে-ভাবে পেরেছি হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাই।
আমি হলে ফিরি তখন রাত আটটা জাবেদ ভাইয়ের রুমমেটরা তাকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে আছে, সবাই ফোন দিচ্ছে। জাবেদ ভাইয়ের পরিচিত যারা সবাইকে কল দিয়েছে, কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারলো না।
রাত নয়টায় জানতে পারি জাবেদ ভাই গুলি খেয়েছে, এখন হাসপাতালে আছে। বাহিরে পুলিশ টহলে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালে গেলাম, জাবেদ ভাইকে শেষবারের মতো দেখতে পারিনি। রক্তাক্ত শরীর দেখে একবার তাকানোর পরে আর তাকানোর সাহস হয়নি।
জাবেদ ভাইয়ের কতো ইচ্ছে ছিলো চাকরি পেয়ে নাদিয়া আপাকে নিয়ে একটা বাসায় উঠবে। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে ঠিকই তবে কিছুই পূর্ণতা পেলো না।
নাদিয়া আপাকে দেখছি, আমার মায়া লাগছে আপাকে দেখে। বুকের ভিতরে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপা আর আসবে না এখানে? নাদিয়া আপা বলল, না, এসে আর কি হবে! আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
নাদিয়া আপা বলল, তোর কাছে জীবনের মানে কি বলতো আমারে? আমি বললাম আপা জীবনের মানে অনিশ্চিয়তা। আপা বলল, এটা ভালো বলেছিস। দেখ জাবেদ আর আমার বিয়ে হলো, তবে আজ! নাদিয়া আপা চুপ হয়ে গেলেন।
নাদিয়া আপা বলল, বাড়িতে গেলে হয়তো তারা যে ছেলেকে পছন্দ করেছে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। কিন্তু আমি আর যাবো বা কোথায় বলবি আমারে? কার জন্যে এই শহরে থাকবো। যদিও তেমন সমস্যা হবে না বাড়িতে, আমার বিয়ের কথা ওরা কেউ জানে না।
নাদিয়া আপার গাল বেয়ে পানি ঝরছে, নাদিয়া আপা কাঁদছেন। আমার চোখটাও ভিজে উঠেছে, আমি কেন কাঁদছি জানি না। চোখের সামনে যে দুজন মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার সাক্ষী ছিলাম, আজ তাদের করুণ পরিণতি দেখছি।
নাদিয় আপা ট্রেনে উঠেছেন, আমি ব্যাগগুলো তুলে দিলাম। ট্রেন কিছুক্ষণের ভিতরেই ছেড়ে দিবে, জানালার পাশে বসে নাদিয়া আপা কাঁদছেন। আমিও কাঁদছি, জাবেদ ভাইকে নাদিয়া আপা রান্না করে দিতেন প্রায়ই, আর সেসবে কতোবার যে ভাগ বসিয়েছি তার হিসেব নেই। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, আপা বললন তুই এবার যা। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপা আবার আইসেন মাঝেমধ্যে। আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমি আর আসবোনারে, তোরা ভালো থাকিস। আপা চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদছিন কেন পাগলা। আমি জানি না কেন কাঁদছি। ট্রেন চলে গেলো, নাদিয়া আপাকে এখন দেখা যায় না, হয়তো পুরো পথ আপা কাঁদবেন।

-মুস্তাকিম বিল্লাহ

source: https://www.facebook.com/100047269985185/posts/1045756980343292/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...