Friday, May 31, 2024

মানবতা অমূল্য

 (সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা )

আলম সাহেব একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করেন। বয়স পঁয়তাল্লিশ।
একদিন এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে আলম সাহেব দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। টেবিলে ভাত তরকারি সালাদ চমৎকার সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। পোলাও বিরিয়ানি নয়, সাদা ভাতই তার পছন্দ। আর চামচ নয়, হাত দিয়ে খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি খাওয়ার জন্য প্রথম লোকমা মুখে যখন তুলবেন তখন তার চোখ পড়লো রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়ালের দিকে। তিনি দেখলেন কাঁচের দেয়ালের ওপাশে পাঁচ ছয় বছর বয়সী একটি হতদরিদ্র মেয়ে বিষণ্ণ চোখে রেস্টুরেন্টের কাস্টমারদের খাওয়া দেখছে। মেয়েটির শুকনো মুখ দেখে বোঝা যায় দুপুরে তার খাওয়া হয় নি। সকালেও বেশি কিছু খেয়েছে বলে মনে হয় না। আলম সাহেব খাবারের লোকমা মুখে না তুলে হাত ইশারা করে মেয়েটিকে ডাকলেন। মেয়েটি প্রথমে বুঝতে পারে নি তাকে যে ডাকছে। কারণ কোনো রেস্টুরেন্টের কোনো কাস্টমার কোনোদিন তাকে ভেতরে ডাকে নি। তাই শুরুতে ভাবলো তাকে নয়, বোধহয় অন্য কাউকে ডাকছে। কিন্তু খানিক পর যখন সে বুঝতে পারলো রেস্টুরেন্টের ভেতরকার ঐ মানুষটা তাকেই ডাকছেন, তখন জড়সড় হয়ে সে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলো।
মেয়েটির মাথায় তেলহীন এলোমেলো চুল, গায়ে ময়লা ছেঁড়া ফ্রক, ধুলো ভর্তি পা দুটো খালি, গা থেকে আসছে কটু গন্ধ। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে আলম সাহেবের টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো। রেস্টুরেন্টের অন্যান্য কাস্টমাররা কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছেন। এমন একটা ঝকঝকে রেস্টুরেন্টে এরকম ময়লা ছেঁড়া জামা, ধুলো ভর্তি পা, গায়ে কটু গন্ধ কোনো বাচ্চা মেয়ে ঢুকে পড়বে এটা তারা আশা করেন নি। কোনো কোনো কাস্টমারের চোখে স্পষ্ট বিরক্তি। যেনো তাদের খাওয়াটা নষ্ট হলো।
তাদের একজন রেস্টুরেন্টের এক বেয়ারাকে ডেকে বললেন,‌"তোমাদের এখানে সিস্টেম বলে কিছু নেই নাকি? ভিখারী ভেতরে ঢোকে কী করে?"
বেয়ারাটি অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,"স্যার আমরা খুবই দুঃখিত। আমরা নিজেরাও অবাক হয়েছি। কারণ এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। আমরা এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি।"
বেয়ারাটি রাগী চোখে বাচ্চা মেয়েটার দিকে ছুটে এলে মেয়েটি ভয়ে নীল হয়ে গেলো। বেয়ারাটি মেয়েটির কাছে এসে কিছু বলার আগেই আলম সাহেব বেয়ারাটিকে থামালেন।
তারপর ভারী গলায় বললেন,"মেয়েটি এখানে ভিক্ষা করতে আসে নি। তাকে আমি ডেকেছি। তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?"
বেয়ারাটি বিগলিত হেসে বললো,"স্যার মেয়েটিকে আপনি ডেকেছেন এটা বুঝতে পারি নি। আমরা ভেবেছিলাম ও বোধহয় হুট করে ঢুকে পড়েছে। ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমরা দুঃখিত।"
বেয়ারাটি চলে গেলে মেয়েটির মুখের ভীত ভাব অনেকখানি দূর হলো। তবে পুরোপুরি দূর হলো না। কারণ এমন কেতাদুরস্ত রেস্টুরেন্টে সে কখনো ঢোকে নি। অনেকেই যে তাকে দেখে অসন্তুষ্ট হয়েছেন এটা সে বুঝতে পারছে।
আলম সাহেব মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন,"দুপুরে খেয়েছো?"
জড়সড় মেয়েটি মাথা নেড়ে না বললো।
আলম সাহেব তার টেবিলের ওপাশে চেয়ার দেখিয়ে বললেন,"বসো এখানে।"
কিন্তু মেয়েটি চেয়ারে না বসে গুটিগুটি পায়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। মেয়েটির এ আচরণ তিনি একদমই বুঝতে পারলেন না। তিনি এটা মোটেই প্রত্যাশা করেন নি। তিনি আশ্চর্য হয়ে মেয়েটির চলে যাওয়া দেখলেন।
কিন্তু একটু পরই তিনি দেখলেন মেয়েটি রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। তবে সে একা নয়। তার সাথে রয়েছে বছর তিনেকের একটা ছেলে। খালি গা, খালি পা, পরনে জিপারহীন প্যান্ট।
আলম সাহেবের কাছে এসে মেয়েটি আলতো করে বললো,"আমার ছোটো ভাই।"
আলম সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন ছোট্ট মেয়েটির ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে। ভাইকে রেখে সে একা খাবে না। তার চোখ ভিজে উঠতে চাইলো। তিনি নিজেকে সামলালেন।
দুই ভাইবোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,"তোমরা বসো।"
আলম সাহেবের টেবিলের সামনের চেয়ার দুটোতে তারা বসলো। তারা শঙ্কিত চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
আলম সাহেব বললেন,"কী খাবে তোমরা?"
মেয়েটি আড়ষ্ট হাতে আলম সাহেবের প্লেটের খাবারের দিকে ইঙ্গিত করলো। অর্থাৎ তিনি যা খাচ্ছেন তারাও তা খাবে।
আলম সাহেব বেয়ারাকে ডেকে দুই ভাইবোনকে একই খাবার দিতে বললেন।
খানিক পর ওদের খাবার এলে তিনজন এক সাথে খেতে শুরু করলো।
তিনি খাচ্ছেন আর আড় চোখে দুই ভাইবোনকে দেখছেন। ছোটো ভাই নিজ হাতে ঠিক ভাবে খেতে পারে না। মেয়েটি তাই নিজের হাতে ছোটো ভাইকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি নিজে এক লোকমা খাচ্ছে, আরেক লোকমা ভাইয়ের মুখে তুলে দিচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে আলম সাহেবের চোখ আবারো ভিজে উঠতে চাইলো। এবারো তিনি নিজেকে সামলালেন।
খাওয়া শেষে তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন,"তোমাদের বাড়িতে কে কে আছে?"
মেয়েটি নিচু স্বরে বললো,"মা।"
"তোমাদের বাবা?"
মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো নেই।
কেনো নেই তিনি এ প্রশ্ন করলেন না। তিনি ধারণা করতে পারেন, হয় ওদের বাবা মারা গেছে, নয়তো আরেকটা বিয়ে করে ওদের ফেলে চলে গেছে। এসব পথশিশুদের পরিবারে এমনই হয়। মা-ই কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখে।
তিনি বেয়ারাকে ডেকে এক প্যাকেট খাবার বেঁধে দিতে বললেন।
তারপর প্যাকেটটি মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে বললেন,"এটা তোমাদের মায়ের জন্য।"
মেয়েটি ধীরে হাত বাড়িয়ে খাবারের প্যাকেটটি নিলো। এরপর দুই ভাইবোন আস্তে আস্তে হেঁটে রেস্টুরেন্ট থেকে চলে যেতে লাগলো।
মেয়েটির এক হাত খাবারের প্যাকেটে আর অন্য হাত ছোটো ভাইয়ের কাঁধে। কী যত্ন করেই না মেয়েটি ছোটো ভাইয়ের কাঁধ ধরে রেখেছে! যেনো আশেপাশে যারা তাদের দেখে অখুশি হয়েছিলেন, তাদের রাগ থেকে ছোটো ভাইকে বাঁচানোর জন্য ওভাবে ধরে রেখেছে। আলম সাহেবের চোখ আবারো ভিজে উঠতে চাইলো। এবারো তিনি নিজেকে সামলালেন।
কিন্তু একটু পর যখন তার কাছে বিল এলো, বিলের দিকে তাকিয়ে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। এতোক্ষণ আটকে রাখা চোখের পানি এবার ঝরঝর করে পড়তে লাগলো।
বিলের কাগজে কোনো সংখ্যা নেই, শুধু লেখা আছে,"মানবতা অমূল্য। এর দাম নির্ধারণ করবো এমন ক্ষমতা আমাদের নেই। স্যার আপনাকে ধন্যবাদ।"
সংগৃহীত

source: https://www.facebook.com/625501851/posts/10159659899726852/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...