Friday, May 31, 2024

মনুষ্যত্বের তালিম

 --মামা,নীলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড যাবেন?

---হু,উঠেন।
---ভাড়া কত?
--(খানিকটা ভেবে) দিয়েন ৪৫টাকা।
এতো দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি,লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম রিক্সায়। কাওরানবাজার থেকে এই রুটে রিক্সাওয়ালারা সাধারণত ৭০ টাকা চোখ বন্ধ করে চেয়ে বসে।আদুরে 'মামা' ডাক শুনে তাদের দিলটা একটু নরম হলে সময়বুঝে ৬০টাকায়ও নেমে আসে ভাড়া। কিন্তু এই মামা কী বুঝে প্রথমেই ৪৫ টাকা চাইলেন তা জানার আগ্রহটা বেশি সময় দমন করে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম "আচ্ছা মামা,আপনি কি এই রাস্তায় নতুন?" ---- অনেক বছর ধরে আমি এই রোডেই আছি।
এবার তো কৌতুহলের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।তাহলে ভাড়া কি আপনি জেনেশুনেই কম চেয়েছেন নাকি? হালকা হেসে মামা রংপুরের ভাষায় যে জবাব দিলেন তা পরিশীলিতরূপে দাঁড়ায় "আপনি তো আমার ছেলের বয়সী, দেখে মনে হচ্ছে পড়ালেখা করেন,তাই একটু কমিয়ে চেয়েছি ইচ্ছা করেই। টাকার অভাবে নিজের ছেলেরে ঠিকমতো পড়ালেখা করাতে পারি নাই, ছাত্র ছাত্রী দেখলে তাই একটু কম রাখি আর কি!মামার গলাটা যে একটু ধরে এল,তা পেছনে বসে থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেল। এরপর কিছুক্ষণ মামাও চুপ,আমিও চুপ।
একনাগাড়ে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। জ্যামের জন্য রিক্সাও আগাচ্ছে কচ্ছপগতিতে।হঠাৎ খেয়াল করলাম মামা রিক্সাটা চালাচ্ছে মূলত একহাত দিয়ে আর অন্য হাতখানা দিয়ে মাঝে মাঝে শুধু সাপোর্ট দিচ্ছে। ভাল মত লক্ষ্য করে দেখলাম হাতখানা তার প্রায় অবশ। জানতে চাইলে মামা বলল "সে অনেক বড় কাহিনী, আপনাদের কি আর এসব শোনার কোন সময় আছে নাকি!
রিক্সা এসে নীলক্ষেত দাঁড়ালো। বেশ জোড়াজুড়ি করার পরে মামাকে নিয়ে গিয়ে বসলাম এক খাবার দোকানে। খাওয়ার ফাকে গল্প চলল কিছুক্ষণ।
ঢাকায় তিনি রিক্সা চালানো শুরু করেন যখন নিজ এলাকার মানুষ এরশাদ সাহেব ছিলেন সর্বেসর্বা ! তারপর এই 'বায়ান্ন বাজার আর তেপান্ন গলির ঢাকা শহর' নিজের রূপ বদলিয়েছে অনেকবার, বদলেনি শুধু মামার জীবনের বড্ড বেশি আঁকাবাঁকা গ্রাফ রেখাটা। মরার ওপরে খাড়ার ঘা হয়ে এল এক এক্সিডেন্ট।
পঙ্গু হাসপাতালে ছিলেন বছরখানেক। ছিন্নমূল মানুষের চিকিৎসা ঠিক যেভাবে হতে দেখা যায়, ব্যতিক্রম ঘটেনি তার বেলাতেও। হাতের ভাঙা হাড় কোনমতে জোড়া লাগে, তবে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অদৃষ্ট তার হাতখানাকে আর আগের মত কর্মক্ষম হবার অনুমতি মঞ্জুর করেনি।
উপায়ন্তর না দেখে ফিরে যান রংপুরে। অভাবের সংসার সবারই।তারপরেও ছোট দুই ভাই চালিয়ে নিচ্ছিলেন একটু আধটু করে। কিন্তু কারও গলগ্রহ হয়ে থাকতে নিজের মনের কাছে বারবার অপরাধবোধ কাজ করছিল তার। সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন দ্রুতই।
ব্যস, আবার ঢাকায় চলে আসলেন মোক্তার আলি।পুরোনো সেই পরীক্ষিত হাতে আবার নতুন করে তুলে নিলেন রিক্সার হ্যান্ডেল। কষ্ট হয় খানিকটা, কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি অন্য কারও কাছে হাত পাততে নারাজ।
দোকান থেকে বের হয়ে মামার হাতে ভাড়ার টাকাটা গুজে দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। মামা হঠাৎ পেছন থেকে ডাক দিয়ে এক্সট্রা টাকাটা ফেরত দিতে চাইল। মৃদু হেসে বললাম --- রেখে দাও মামা, কোন না কোন দিন হয়ত আবার তোমার রিক্সায় উঠতে হবে...."
কী মনে করে যেন মামার একটি ছবি তুলে রাখলাম হাতের নষ্টপ্রায় মোবাইল ক্যামেরায়।
কাজের তাড়া ছিল খানিকটা। দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম.........
স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি মনুষ্যত্বের কিছু তালিম এই মামাদের কাছ থেকে নিলে নেহাত মন্দ হয় না ব্যাপারটা! অন্তত আমাদের দেশের অনেক ডিগ্রিধারী হর্তা-কর্তাদের জন্য তার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম!!!!!


লিখেছেন : সাইয়েদ আব্দুল্লাহ

https://www.facebook.com/100002578672817/posts/7617523025010244/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...