Friday, May 31, 2024

বাবার কান্ড

 চাকরি হবার পর প্রথম মাসের বেতন এনে ভাবলাম মাকে দিবো।কারণ মা-ই কঠোর মেহনত করে আমায় পড়াশোনা করিয়েছেন।বাবা সেই শুরু থেকেই বাঁধা দিতেন। বলতেন, তার সঙ্গে রাজ মিস্ত্রীর কাজ করতে।এতে করে দুটো পয়সা বেশি আসবে ঘরে। নিজেদের উন্নতি হবে।

সবাই তো আর সমান বোঝে না।বাবা হয়তো কাজের বিনিময়ে উপস্থিত ক'টা টাকা বেশি ঘরে আসবে এই স্বপ্নই দেখছিলেন। কিন্তু মা স্বপ্ন দেখেছিলেন আকাশ সমান। তিনি বাবার অমতে গিয়ে আমায় স্কুলে দিলেন। মায়ের গয়না ঘাঁটি,নানার দেয়া সামান্য টাকা এসব বেচে দিয়ে যা টাকা এলো তা বাড়িয়ে বলিয়ে যা হয়েছিল তা আমার পড়াশোনার পেছনে ঢাললেন। মাধ্যমিক পর্যন্ত মার কাছ থেকে খরচ নিতে হতো আমার। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় টিউশন পেয়ে গেলাম। নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারতাম তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হওয়ার পর মাকে মাস শেষে হাজার দুয়েক দিতে পারতাম। পড়াশোনা শেষ হবার পর চাকরি হলো। প্রথম মাসের বেতন পেলাম। এই বেতন আজ মার হাতে তুলে দিবো বলে মাকে খুঁজছি। খুঁজতে গিয়ে দেখি মা পুকুর ঘাটে।কলসি ভরে পানি তুলছে।মার হাত থেকে কলসি নিয়ে খানিক দূরে সেই কলসি সরিয়ে রেখে তারপর বললাম,' চোখ বন্ধ করো তো একটু মা।'
মা অবাক হলো।মার সঙ্গে কখনোই আমি এরকম রসিকতা করিনি। এই জন্যই অবাক হয়েছে।
মা বললো,' কেন? চোখ বন্ধ করলে কী হবে?'
আমি বললাম,' করে দেখো না কী হয়! ভালো কিছুই হবে হয়তো।'
মা চোখের পাতা বন্ধ করলো। এবার মায়ের ডান হাত টেনে নিয়ে সেই হাতে টাকা ভর্তি হলুদ খামটা মুঠোতে পুরে দিয়ে বললাম,' আরো তিন মিনিট পর চোখ খুলে দেখবে এটা কি!'
বলে আমি কলসি নিয়ে ঘরে চলে এলাম।
মিনিট কয়েক পর মাও এলো। মায়ের চোখ জলে ভেজা।আমি জানি এটা দুঃখের জল না। সুখের জল। নিজের পরিশ্রমের স্বার্থকতার পর যে মনে আনন্দ হয়, সেই আনন্দের জল।
মা ঘরে এসে বললো,' এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো মহিন? আমাকে দশ টাকা না দিলেও আমি খুশি। তুই এই টাকা নিয়ে তোর বাপকে দে।'
আমার রাগ লাগলো।আমি বললাম,' বাবাকে দিবো কেন? তিনি তো আমায় রাজমিস্ত্রীর কাজে লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন!'
মা হাসলেন। বললেন,' সহজ সরল মানুষ। সহজ সরল মানুষেরা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে না।তারা বর্তমান নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেথাকে। উদ্বিগ্ন থাকে। তাছাড়া আমাদের অবস্থাও তো তেমন ভালো ছিল না।তোর বাপ একা উপার্জন করতো।একা এই সংসারের বোঝা টানতে হতো তার। নিজের কাঁধের ভার হয়তো লাঘব করতে চেয়েছিল সে!'
আমি কোন কথা বলি না।চুপ হয়ে থাকি।
মা বলেন,' তোর বাপের পাঞ্জাবিটা পুরনো হয়ে গেছে। ছিঁড়ে গেছে এক জায়গায়।নিচের সেন্ডো গেঞ্জিটা তো জালের মতো ছোট ছোট ছিদ্র হয়ে গেছে। একজোড়া ভালো জুতো নাই।তোর বাপ নিজের জন্য কিছুই করেনি। হয়তো তোর পড়াশোনার পেছনে তেমন খরচ করেনি। কিন্তু টাকা পয়সা উপার্জন করে যে কিছু ক্ষেত খামার করেছে,ঘরটা বেঁধেছে তা তোর তোর জন্যই রে বাবা। তার নিজের জন্য কিছুই করেনি।বাবারা এমনই রে।মায়েরাও। সন্তান হবার পর তারা আর নিজেদের নিয়ে ভাবে না। নিজেদের সুখের জন্য, শখের জন্য কিচ্ছু করে না।যা করে তা নিজেদের সন্তানের জন্য।এর প্রমাণ তো তোর বাবাই। সে কি ইচ্ছে করলে তার উপার্জিত দিয়ে একটা ভালো জামা, গেঞ্জি,জুতো কিনতে পারতো না? নিশ্চয় পারতো। কিন্তু কিনেনি? এইসব টাকা দিয়ে জমি কিনেছে।ঘর করেছে।তা তোর জন্যই রে বাবা। তার নিজের জন্য না!'
মার কথা আমার ভালো লাগলো।আমি জানি আমার মা কতোটা জ্ঞানী।কতোটা স্বার্থহীন।
এমন লক্ষ্মী মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন ভরে যায়।মনে শান্তি আসে।আমি দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বয়সে, চিন্তায় এই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মায়া আর মমতায় আজো এই মুখ উজ্জ্বল।লাবণ্যময়।
সেদিন বিকেলেই আমি বাবাকে বললাম,' বাবা, তোমার একটু সময় হবে? তোমাকে নিয়ে আমি বাজারে যেতে চাইছিলাম একটু!'
আমার চাকরি হবার পর থেকেই বাবা আমায় অন্য রকম চোখে দেখে। পছন্দ করে।আমায় গুরুত্ব দেয়।
বাবা না করলেন না। তখনই বললেন,' এখন যাবি?"
আমি বললাম,' হ্যা ‌।'
বাবা বললেন,' আচ্ছা।'
ঘরে গিয়ে বাবা ঘিয়ে রঙা পুরনো পাঞ্জাবি পরলেন। অনেক দিন না কাঁটা চুল আঁচড়ে এলেন। পুরনো স্যান্ডেল তার পায়ে।এক জায়গায় সেলাই করা। ছিঁড়ে গিয়েছিল সম্ভবত।
বাবাকে নিয়ে অটো করে বাজারে গেলাম। তারপর প্রথমেই সেলুনে গিয়ে বাবার চুল কাটালাম। মার্কেটে নিয়ে গেলাম। বাবার জন্য যখন কাপড় বের করি তখন বাবা জোর জবরদস্তি করেন। কিনতে বারণ করেন। বলেন,' আরে আমার তো আছে। শুধু শুধু কেন টাকা খরচ করবি!যখন কাপড় থাকবে না তখন কিনে দিস। '
আমি বাবার কথা শুনি না। পাঞ্জাবি কিনে দেই দুটো।একটা ফতুয়া কিনি। লুঙ্গি কিনি। জুতো কিনি দু 'জোড়া। একজোড়া স্যান্ডেল। একজোড়া চামড়া। তারপর বাকী সব টাকা বাবার হাতে তুলে দেই।বলি,' বাবা, আমার চাকরির প্রথম মাসের বেতন। কেনাকাটা করে এগুলো অবশিষ্ট আছে।'
বাবা টাকাগুলো কাঁপা কাঁপা হাতে নেন। আমার সামনেই দোকানির কাছ থেকে শাড়ি নেন। জলপাই রঙা শাড়ি। খয়েরি আঁচল।জুতো নেন মেয়েদের। চামড়ার জুতো। মাথায় দেয়ার সুগন্ধি তেল নেন।সাবান নেন।শেষে ফেরার সময় বেশি করে মিষ্টি নেন।বাড়ি ফিরে মাকে তিনি নিজ হাতে উপহার দেন।নিজে নতুন পাঞ্জাবি- লুঙ্গি আর চামড়ার জুতো পরে পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে মিষ্টি বিলাতে যান।জনে জনে বলে বেড়ান,' আর যাই করো বাচ্চা কাচ্চার পড়াশোনা ঠিক রাইখো। পড়াশোনা করাইয়ো।বাপ মায়ের সম্পদ হইলো তাদের সন্তান।আর সন্তানের সম্পদ হইলো তাদের শিক্ষা দীক্ষা।'
আমার বড় ভালো লাগে বাবার এসব পাগলামি দেখতে। আনন্দে চোখ ভিজে উঠে বার বার।
সময় যাচ্ছে। চাকরি হয়েছে অনেক দিন।বাড়ি থাকতে পারি না। চাকরির সুবাদে দূরে থাকতে হয়। বাবাকে বলি আমার এখানে এসে থাকতে।বাবা আসেন না। বলেন,' গ্রামের মানুষ গুলো কম বোঝে। শিক্ষা দীক্ষার প্রতি এদের মনোযোগ কম।আমি যদি বাড়ি থেকে চলে যাই তবে এদের শিক্ষা দীক্ষার কথা বলবে কে?'
আমি এসব শুনে হাসি।
মা ফোন করে বলেন,' তোর বাপ ইদানিং যা কান্ড করে!'
আমি জিজ্ঞেস করি,' কি করে?'
মা বলেন,'
নিজের কাজ কর্ম রেখে মানুষের কাজ কর্ম করে বেড়ায়।কেউ তার বাচ্চাকে কাজে লাগালে সে গিয়ে বলে,আমি কাজ করে দেই। তোমার ছেলে পড়ুক গিয়ে। তারপর তোর বাবা কাজে লেগে পড়ে।'
শুনে আমার হাসি পায়। আনন্দ হয়।সে যে কি অসীম আনন্দ বুঝাবো কি করে?

source : https://www.facebook.com/100094585744054/posts/269857596177097/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
'

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...