Saturday, September 7, 2024

পারস্পরিক শ্রদ্ধা

 বন্ধু প্রথম এলো আমাদের বাড়িতে। আমরা খাচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম। খাওয়া শেষে বন্ধুর কাছে সময় চাইলাম কয়েক মিনিট─ "একটু বোস্‌ রে, আমি প্লেটগুলো পরিষ্কার করে এখনই আসছি কিচেন থেকে।" বলে, প্লেটগুলো হাতে তুলে নিচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, বন্ধু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমার স্ত্রী ততোক্ষণে কিচেনে চলে গেছে।

আমাকে ভদ্রভাবেই জিজ্ঞেস করলো সে অতঃপর─ "স্ত্রীকে সাহায্য করছিস কাজে, দেখে আমার ভালোই লাগছে রে। আমার মূলত ওর কাজে হেল্প করা হয় না, আগ্রহটিই মরে গেছে। শুরুতে কয়দিন করেছিলাম ওর কাজে হেল্প, কিন্তু ধন্যবাদটুকুও দেয় না। শেষবার যখন পুরো মেঝেটা পরিষ্কার করেও কোনো ধন্যবাদ পেলাম না, ওর কাজে হেল্প করা ছেড়েই দিলাম একেবারে।"
বন্ধুটিকে আমি খুব পছন্দ করি। খুব ভালো ছেলে। আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, তাকে এই 'হেল্প' বিষয়ে আমার ভাবনাটি বলা উচিৎ হবে কিনা। কেউ তো কারও চেয়ে কম বোঝে না এই সময়ে! তবু, মনে হলো, এই ভালো ছেলেটি ছোট্ট একটি ভুল ধারণা মস্তিষ্কে পুষে রেখে আসন্ন সুন্দর দাম্পত্য জীবনটিকে জটিল করে তুলছে খুব সম্ভবত। আমি তো বন্ধু ওর, আমার কি উচিৎ নয় তাকে এই ছোটখাটো ভুল ভাবনার বিশাল ও মারাত্মক প্রভাব বিষয়ে একটু সতর্ক করা? আমি দোদুল্যমানতা কাটাতে পারলাম অবশেষে।
প্লেটগুলো টেবিলের একপাশে সরিয়ে রেখে, মুখোমুখি বসলাম আবারও। আশ্বস্তের স্বরে বলতে আরম্ভ করলাম বন্ধুর চোখে চোখ রেখে─
"দোস্তো, আমি স্ত্রীকে 'হেল্প' করছি না। সত্যি বলতে কি─ এই হেল্প-এর তাঁর প্রয়োজনই নেই। তাঁর একজন পার্টনারের প্রয়োজন ছিল জীবনে, দাম্পত্যসাথীর প্রয়োজন ছিল; একারণেই তো আমরা একসাথে আছি। আমি ও সে মিলে, একটি টিম মূলত। আমরা পরস্পরের টিম-মেট। আমি ওর হোম-পার্টনারও, অতএব সংসারের সমস্ত কাজ ভাগাভাগিতে করি আমরা, পার্টনারশিপ-শেয়ারিং-এ। এই ভাগাভাগিকে আমি কিভাবে 'হেল্প' বলতে পারি? এ 'সাহায্য' নয় রে, একে আমরা বলতে পারি─ টিমকে সচল রাখতে টিমের প্রত্যেক সদস্যের একে-অপরকে 'সহযোগিতা' করা, দায়িত্বের ভাগাভাগিতে। 'সাহায্য' ও 'সহযোগিতা' আলাদাই রে, তাই না?
ঘর মোছায় আমি স্ত্রীকে 'সাহায্য' করি না; কারণ এই ঘরে আমিও থাকি, অতএব একে পরিষ্কার আমাকেও করতে হবে। 'সহযোগিতা'।
রান্নায় স্ত্রীকে 'সাহায্য' করি না আমি; কারণ আমিও খাই, আমাকেও রান্নার কাজে যতোটা পারি 'সহযোগিতা' করতে হবে।
খাওয়া শেষে প্লেট ধোওয়ায় ওকে 'হেল্প' করি না আমি; এই প্লেটে আমিও খাই, আমারও দায়িত্ব এই প্লেট পরিষ্কার করা, সহযোগিতা করা।
বাচ্চাদের যে-কোনো কাজে আমি স্ত্রীকে 'হেল্প' করি না; ওরা আমারও সন্তান, ওদের প্রতিটি প্রয়োজনে ভূমিকা রাখা আমার অংশীদারিত্বের মধ্যেও পড়ে। তাহলে?
আমাদের, বাচ্চাদের, জামাকাপড় ধোওয়া, বাজার করা, এই সব ক্ষেত্রেও আমি বলবো, আমরা পরস্পরকে 'সাহায্য' করি না; আমরা পারস্পরিক 'সহযোগিতা'য় সংসার-টিমটিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
আমি 'সাহায্যের হাত' বাড়িয়ে দেই না আমাদের সংসারের কোনো কাজে, আমি এই সংসারেরই একটি অংশ হিসেবে নিজের দায়িত্বটিই সম্পাদন করি।
বন্ধু, সংসারের বাইরেও আমরা উভয়ে যার-যার মতো এইযে কাজ করছি, উপার্জন করছি, এ তো এই সংসারের জন্যই। তো, আমাদের ওই কাজের পরে, এই সংসারের মধ্যেও তো আমাদের যার-যার কাজ রয়েছে দায়িত্বে! আমি এভাবেই ভাবি রে!"
আমার বন্ধুটি আহত হলো না এসব কথায়। সে মনোযোগ দিয়ে শুনলো সমস্তটা। তার আগ্রহ লক্ষ্য করে, এ পর্যায়ে আমি ভদ্রতার সাথেই জানতে চাইলাম─ "সর্বশেষ কবে তুই, স্ত্রীর ঘর মোছা, রান্না করে খাওয়ানো, বাজার করা, বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো, কাপড় ধোওয়া, এমনকি বেডশিট পাল্টানোর জন্য, তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছিস?"
বন্ধু চুপ হয়েই রইলো।
─ "ধন্যবাদ আমরা দেই না স্ত্রীদেরকে, তো আমরা কিভাবে আশা করছি তাঁদের কাছ থেকে 'ধন্যবাদ'?
আমাদের পাঠ্যবই, আমাদের সমাজ, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের নিজেদের পেশিশক্তির গৌরব, এইসবই আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে এই বীভৎস ভ্রান্ত ধারণাটি ঢুকিয়ে দিয়েছে, যে─ ঘরোয়া কাজ মেয়েলি; এসব করবে মেয়েরাই। এসব করলে আমাদের জাত যাবে। আমরা সেরা প্রজাতি, ওরা তো দ্বিতীয়-লিঙ্গ মাত্র! এই ভাবনাই আমাদের সংসারে ফাটল ধরার, সংসারের মুখ থুবড়ে পড়ার, অন্যের সংসারের উন্নতি দেখে পরশ্রীকাতর হওয়ার, মূল কারণ দোস্তো। এই কুৎসিত ভাবনার সবচেয়ে বড়ো ক্ষতিটি হলো─ আমরা এই ভাবনাটি আমাদের সন্তানদের মাথায়ও ঢুকিয়ে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত; ফলে আমাদের সন্তানরা হয়ে উঠছে সংসারবিমুখ, নারীর প্রতি মর্যাদাবোধহীন; এর প্রতিক্রিয়ায় নারীরাও হয়ে উঠছে এরকম ছেলেদের প্রতি বিরক্ত ও সম্মানবোধহীন, এমনকি আমাদের পুত্ররা এরকম অসভ্য ধারণার কারণেই মূলত হয়ে উঠছে নির্যাতনকারী, রেইপিস্ট। আয়, আমরা পরিবার থেকেই আরম্ভ করি; এভাবে আমাদের সন্তানেরা গড়ে উঠবে সুস্থ মানসিকতার মানুষ হয়ে একেকজন, ওরা গড়ে তুলবে সুস্থ সমাজ; এভাবেই তৈরি হোক একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ অপরূপ মানবজাতি। পৃথিবীটা সুন্দর হোক।"
Salah Uddin Ahmed Jewel

source: https://www.facebook.com/100011467223962/posts/2331085307283687/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v

No comments:

Post a Comment

বল্টু

  ●বল্টু : আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তার : কি..? বল্টু : যখন যার সাথে কথা বলি তাকে দেখতে পাইনা। ডাক্তার : কখন এরকম হয়..? বল্টু: যখন ফোনে ক...