বিয়ের পরেরদিন আমার স্ত্রী "বেলা" পরিবারের সবার জন্য দুপুরে নিজ হাতে রান্না করেছে। সবাইকে খাবার পরিবেশন করে উচ্ছাসিত কণ্ঠে জানতে চাইলো, "মুরগীর মাংসটা কেমন হয়েছে?"
আমি সবেমাত্র এক লোকমা ভাত মুখে তুলে ছিলাম, এখন গলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অতিরিক্ত লবন, মরিচের ফলে মাংসের স্বাদ নষ্ট হয়ে অ'খা'দ্য হয়েছে। আমি কিছু বলার আগেই আমার আম্মা আমায় ইশারায় চুপ থাকতে বললো। এরমধ্যে পাশ থেকে বাবা মাংস চিবাতে চিবাতে বললো, "বউমা রান্নাতো দারুণ হয়েছে! আজকে মনে হচ্ছে আমার মায়ের হাতের সেই সুস্বাদু খাবার খাচ্ছি।"
বেলা খুশিতে গদগদ করে বললো,
"বাবা আপনাকে আরেকটু মাংস দেই?"
"দেও বউমা। আজকে ডালটাও খুব মজা হয়েছে।"
বেলা হাসি হাসি মুখে বাবা'কে তুলে এটা সেটা দিচ্ছে, বাবা প্রশংসা করছে। আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম রান্না করতে গিয়ে ওর ডান-হাতটা পু'ড়ে গিয়েছে। বাবা'র ঘরে খুব আহ্লাদী মেয়ে বেলা, রান্না ঘরের ধারে-কাছেও যায়নি কখনো। আজ ওর পো'ড়া হাতের দিকে তাকিয়ে সবাই চুপচাপ এই অখাদ্যই অমৃত মনে করে গিলে নিলাম। সব শেষ করে বেলা যখন খেতে বসলো। খাবার মুখে নিয়েই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। পরমুহূর্তে অপরাধীর ন্যায় মুখ কালো করে বললো,
"এতো জঘন্য খাবার তোমরা কি করে খেলে? আমি সব খাবার গুলোই নষ্ট করে ফেললাম।"
মা ওর মুখে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো, "রান্না করতে করতে একদিন সব শিখে যাবে মা। মন খারাপ করো না! আমরা কিচ্ছুটি মনে করিনি।"
আমাদের উৎসাহ আর সবার থেকে সাপোর্ট পেয়ে বেলা হতাশ না হয়ে মায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন রান্না আগ্রহ নিয়ে শিখছে। ইউটিউব দেখে নিত্য নতুন রেসিপির ট্রাই করছে। যদিও খুব একটা ভালো হতো না সেসব, হয়তো লবনে বেশি বা কম হতো নয়তো ঝাল হতো, পুড়ে যেতো। তবুও আমার মা-বাবা বলতো খুব ভালো হয়েছে খাবার। মাঝে-মধ্যে আমি খুঁত ধরলে আম্মা রেগে গিয়ে বউয়ের সাপোর্ট করতেন। এতে বেলা আনন্দে পায়। আমি বললেও সেসব মন থেকে বলতাম না। আসলে যাতে আমার বউকে মা-বাবা কথা শুনানোর সুযোগ না পায়, সেজন্য তাদের কথা গুলো আমি বলে দিতাম। আবার সবার আড়ালে সরি ও বলতাম বেলা'কে।
বিয়ের পনেরো দিন পর আজ অফিসে আসছি। সকালে আমার বউ যত্ন করে দুপুরের খাবারের টিফিন রেডি করে তুলে দিলো আমার হাতে।আবার লাঞ্চ টাইমে কল দিয়ে বললো, "খেয়েছো মাহমুদ?"
"না। মাএ কাজ শেষ হলো। এইতো এখন খাবো। তুমি খেয়েছো?"
"উঁহু। তুমি খেয়ে নেও, আমিও এখন খাবো।"
"আচ্ছা রাখছি। টেক কেয়ার।"
হাসি মুখে বউয়ের কল কেটে খেতে বসলাম। বক্স খুলে দেখি ভাত, আধপোড়া শাক ভাজি, আর মাছ দিয়েছে বউ। আমি বউয়ের হাতের এই পোড়া তিতকুটে স্বাদের খাবার খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছি। এই খাবারে যতটুকু ভালোবাসা মিশানো আছে, তা ওই বড়সড় রেস্টুরেন্টের খাবারেও কখনো পাইনি। এরিমধ্যে আমার কলিগ শাহাদাত এসে বললো, "এতো মজা করে, কি খাচ্ছেন ভাই?"
"এইতো ভাই শাক আর মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছি।"
"নতুন ভাবি রান্না করেছে নাকি?"
"জি, আপনার ভাবিই রান্না করেছে।"
"নতুন ভাবির হাতের রান্না নিশ্চয়ই লোভনীয়!"
"তা বটে!"
"আপনার কপাল ভাই! দুইবছর হলো বিয়ে করছি তাও আপনার ভাবির হাতের রান্নায় কোনো স্বাদ পাই না। কি যে রাঁধে!"
হতাশ হয়ে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে খাবার বের করলো শাহাদাত ভাই। উনার মুরগির মাংসের ঘ্রান ছড়িয়ে গিয়েছে, কালার টাও সুন্দর। দেখেই মনে হচ্ছে, রান্না মজা হয়েছে। তবুও কিছু পুরুষ আছে নিজের স্ত্রী যত ভালোই রাঁধুক পেটপুরে খেয়েও বলবে, ভালো হয়নি। এরা কখনো তো প্রশংসা করেই না উল্টো খুঁত ধরে। এদের কাছে পরের হাতের বিশ্রী স্বাদের খাবারও মজার হয়। আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ খাচ্ছি। তা দেখে উনি আবারও বললেন, "নতুন বউয়ের হাতের খাবার একা একা খান কেন মিয়া! আমাদেরও একটু শেয়ার করেন।"
আমি বাধ্য হয়ে এক-টুকরা মাছ তুলে দিলাম উনার পাতে। আমার বউয়ের হাতের লবনাক্ত মাছ উনি একটুখানি মুখে দিয়েই মুখ কুঁচকে ঠাট্টা করে বললেন,"আপনার খাওয়া দেখে ভাবলাম ভাবির হাতের রান্না না জানি কত মজা! এটা মাছ ভাজি নাকি তেঁতো করলা? এসব বিশ্রী খাবার আপনি কেমনে গিলেন ভাই? হুদাই খাবার নষ্ট করা!"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "আপনি খাবারের স্বাদ খুঁজলেও আমি এতে খুঁজে পেয়েছি ভালোবাসা ভাই। আমার স্ত্রী ভোর পাঁচটায় উঠে একা একা সব গুছিয়ে আমাকে গরম গরম রান্না করে সকালে খাইয়ে দেয়। আসার সময় মনে করে দুপুরের খাবারের বক্স হাতে তুলে দেয়। যে মানুষটা আমার জন্য এতকিছু করে, তার খাবার কি করে খারাপ হয় বলুন তো? আজ রান্না খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে? একদিন ঠিক ই ভালো হবে।"
এরমধ্যে আমার খাওয়াও শেষ। আমি আর কিছু উনাকে না বলতে দিয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম। বউকে কল দিয়ে বললাম, "আজকের রান্নাটা অনেক মজা হয়েছে বেলা।"
বউ খুশী হলো। উৎসাহিত কণ্ঠে জানালো, "আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি তোমার পছন্দের পায়েস বানাচ্ছি।"
আমি হেসে সম্মতি জানালাম। ফোন কেটে নিজের কাজে গেলাম।
_________
পাগলীটার সাথে দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেলো। আজ আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে নিকটতম আত্মীয় স্বজন ও শাহাদাত ভাইকে দাওয়াত দিয়ে, ঘরোয়া আয়োজন করেছি। কেক কাটার পর্ব শেষ করে সবাইকে খাবার দিয়েছি। সবাই খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে। এরমধ্যে শাহাদাত ভাই খাবার মুখে দিতে দিতে বললেন, "কাচ্চিটা যা হয়েছে না ভাই! কোন রেস্টুরেন্টে থেকে অর্ডার করছেন?"
আমি কিঞ্চিৎ হেসে বললাম, "এগুলো সব আপনার ভাবিই রান্না করেছে ভাই। বলছিলাম না একদিন ঠিকই রান্না শিখে যাবে। বুঝলেন ভাই, ঘরের বউকে ভালোবাসতে হয়। তাদের খারাপ কাজেও গাল-মন্দ না দিয়ে উৎসাহ দিতে হয়। এতে তারা হতাশাগ্রস্ত না হয়ে মনোবল পায়, কাজের প্রতি মনোযোগী হয়। বাবার ঘরের অকর্মা মেয়েটাও আজ কাজ না পারলে, কাল ঠিকই শিখে যায়। শুধু এই সময়ের আপনার/আমার করা ব্যবহারটা তার মনের মাঝে রয়ে যায়। বুঝলেন ভাই?"
(সমাপ্ত)
লেখনীতেঃ #সুমাইয়া_আফরিন_ঐশী
source: https://www.facebook.com/100014866035700/posts/1980995059072676/?mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
No comments:
Post a Comment